ব্যাংক খাত সংস্কারে শিগগির কমিশন গঠন
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গভর্নরের বৈঠক আর্থিক খাত সংস্কারের ‘রূপকল্প’ সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশের সিদ্ধান্ত।
ব্যাংক খাত সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই করতে দ্রুত একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
একই সঙ্গে আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
রোববার দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত এসেছে।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারের বিষয়টি চলে এসেছে। ব্যাংকিং খাতে টেকসই সংস্কার করার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
”আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।”
বৈঠকে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়েও আলোচনা হয়। চাহিদা ও যোগানের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। তবে মূল্যস্ফীতির সুফল পেতে সবাইকে একটু ধৈর্য ধরার আহ্বান করা হয়েছে।
টানা দুই বছর থেকে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি গত জুলাইয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে সীমিত আয়ের মানুষ নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়েছে।
তুমুল গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেও মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানো বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার গঠনের ১০ দিনের মাথায় প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে এটিকে সামাল দেওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে, কর্মপন্থাও ঠিক করার তথ্যও দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক শেষে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এজন্য মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক অবস্থায় ধরে রাখতে হবে এবং একইসাথে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাই এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে।”
এদিনের বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতেও করণীয় ঠিক করা হয়েছে। ডলার সংকট কাটাতে বেশ কিছুদিন আগে বিদেশি মুদ্রা লেনদেন বাজারভিত্তিক করা হয়। সরবরাহ আরও বাড়াতে বৈঠকে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ‘ব্যান্ড ১ শতাংশ হতে বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ’ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ডলার কেনাবেচার বর্তমান দর ১১৭ টাকা। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মধ্যবর্তী এ দর থেকে এক টাকা বেশি বা কমে কেনাবেচা করা যায়।
’ব্যান্ডের’ হার বাড়নোতে সংকট কাটবে আশা প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আশা করা যাচ্ছে খুব দ্রুতই আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে তারল্য ফিরে আসবে এবং বিনিময়ের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।“
এর আগে বুধবার আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডলারের সরবরাহ কীভাবে বাড়ানো যাবে, সে বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কাজ করবে।
ব্যাংক খাতে অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যাংকিং কমিশনের বিষয়টিও সামনে এসেছিল সেদিন। তখন তিনি বলেছিলেন, “ব্যাংকিং কমিশন কিংবা টাস্কফোর্স যাই গঠন করা হোক, দুর্বল ব্যাংকগুলোতে অডিট করতে হবে। এটা নিয়ে একটা টাস্কফোর্স কিংবা কমিশন দিয়ে কাজ করতে হবে।
”যেসব দুর্বল ব্যাংক আছে, তাদের সবার অডিট করতে হবে। তাদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কী রকম সাহায্য দেওয়া হবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা হবে। এছড়া মালিকানা পরিবর্তনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটাও নির্ধারণ হবে অডিটের মাধ্যমে।”
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও ব্যাংক কমিশনে গঠনের বিষয়টি অনেকবার সামনে এসেছিল। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের একের পর এক অভিযোগের মধ্যেও কমিশন গঠনের বিষয়টি প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়।
জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৪ জুন বলেছিলেন, “ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
এর আগে ২০১৬ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ব্যাংক খাতকে আরও বেশি নজরদারির মধ্যে আনতে একটি কমিশন গঠনে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এরপর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, ওই কমিশন তিনি গঠন করবেন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকারের শেষ বছরের বাজেট দিয়ে তিনি বলেন, ওই মেয়াদে আর ব্যাংক কমিশন হচ্ছে না।
ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে তিন মাসের জন্য জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার সুপারিশ করে সবশেষ সিপিডি বলেছে, “এ খাতে ‘দ্বৈত প্রশাসন’ কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করতে হবে। এ বিভাগের জন্য সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই।”
সরকার পতনের পর গত ১২ অগাস্ট ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের দুষ্টু চক্র ভেঙে ফেলতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।